ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: “আমাদের কাজ চুরির বর্ণনা দেয়া, চোর ধরা নয়”
- By Jamini Roy --
- 02 December, 2024
বাংলাদেশে ১৫ বছরের সরকারী দুর্নীতি এবং এর প্রভাব নিয়ে একটি বিস্তৃত শ্বেতপত্র তৈরি করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্বেতপত্রের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিলো দুর্নীতির প্রক্রিয়া বর্ণনা করা, চোর ধরা নয়। কমিটি ১২ জন অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো এবং এর কাজ ছিলো সরকারের দুর্নীতির সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, শ্বেতপত্রটি একটি স্বাধীন কমিটির কাজ, যেখানে সরকার বা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আক্রমণ নয়, বরং দুর্নীতির পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শ্বেতপত্রটি তৈরির জন্য কমিটির সদস্যরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন, এবং ৩ মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর এটি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারই এর গ্রন্থস্বত্ব ধারণ করবে।
কমিটির পর্যবেক্ষণে যে-সব বিষয় উঠে এসেছে তা হলো-
১. রাজস্ব ফাঁকি ও আর্থিক ক্ষতি:
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের রাজস্ব ফাঁকি এবং দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। এই অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব ছিল।
২. সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি:
গবেষণায় বলা হয়েছে, বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় ৭০% বেড়েছে এবং সময়সীমা পাঁচ বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে।
৩. খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন ধ্বংস:
শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইনে গৃহস্থালির উৎপাদন পরিসংখ্যান বিকৃত করা হয়েছে, যা বাজারের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ক্রয় নীতিমালা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে এবং বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে।
৪. ব্যাংকিং এবং আর্থিক ব্যবস্থা:
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ঋণদান প্রক্রিয়া ব্যাংকিং খাতের সংকট আরও গভীর করেছে। এছাড়া ঋণ খেলাপি এবং জালিয়াতির কারণে আর্থিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৫. শ্রম অভিবাসন:
শ্বেতপত্রে শ্রম অভিবাসন খাতে সিন্ডিকেটের শোষণ ও হুন্ডি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এতে শ্রমিকরা ন্যায্য চাকরি পেতে পারেনি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
৬. সামাজিক সুরক্ষা:
সামাজিক সুরক্ষা তহবিলের অপব্যবহার লাখ লাখ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। ২০২২ সালে ৭৩% সুবিধাভোগী গরিব হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হয়নি।
৭. পরিবেশ ব্যবস্থাপনা:
জলবায়ু অভিযোজন তহবিলের মধ্যে দুর্নীতি পরিবেশগত ক্ষতি বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষক জলবায়ু সম্পদের অপব্যবস্থাপনা স্থায়িত্বমূলক উন্নয়ন উদ্যোগগুলোকে ব্যাহত করেছে এবং পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, রিপোর্টটি এখনো খসড়া হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং পরিসংখ্যানের কিছু অংশ পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে, এবং এটি সরকার নিজেদের দলিল হিসেবে স্বীকার করেছে।
এছাড়া শ্বেতপত্রের প্রক্রিয়াটি দেশের স্বার্থে তৈরি করা হয়েছে এবং এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে, বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।